রাজধানীর মেট্রোরেল স্টেশনে শিগগিরই চালু হতে চলেছে সম্পূর্ণ দেশের প্রযুক্তিতে নির্মিত ও পরিচালিত স্মার্ট ডেলিভারি লকার সেবা। এই স্বয়ংক্রিয় ডেলিভারি বক্সের মাধ্যমে মেট্রোরেল ব্যবহারকারীরা তাদের ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মে অর্ডার করা পণ্যের ডেলিভারি কোন ডেলিভারিম্যানের উপস্থিতি ছাড়াই শুধু স্মার্টফোনের মাধ্যমে ওটিপির দ্বারা খুব সহজে এবং সুবিধাজনক সময়ে মেট্রোরেল স্টেশনে স্থাপিত এই স্মার্ট লকার থেকে নিজে সংগ্রহ করতে পারবেন। এ লক্ষ্যে রোববার রাজধানীর প্রবাসী কল্যাণ ভবনে এটুআই এবং ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)-এর মধ্যে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এটুআই-এর প্রকল্প পরিচালক (যুগ্মসচিব) ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর এবং ডিএমটিসিএল-এর সচিব (যুগ্মসচিব) মোহাম্মদ আবদুর রউফ নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে চুক্তি স্বাক্ষর করেন।
এই চুক্তির আওতায় এটুআই এমআরটি-৬ এর অন্তর্গত সকল মেট্রোরেল স্টেশনের সুনির্দিষ্ট কিছু স্পেইস ডিএমটিসিএল-এর ভাড়া/ইজারা নীতিমালা ২০২৩ এ বর্ণিত শর্তাবলী মেনে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে শর্তসাপেক্ষে ব্যবহার করবে। ইন্টারনেট-সংযোগ ভিত্তিক আইওটি প্রযুক্তি দেশের প্রথম এই স্মার্ট-ডেলিভারি লকার সিস্টেম-এর অবকাঠামোর স্থাপন ও পরিচালনার জন্য ব্যবহার করা হবে। পর্যায়ক্রমে, নানাবিধ সরকারি সার্ভিসের পেমেন্ট এবং ই-টিকেটিং সার্ভিস সহজিকরণ ও ত্বরান্বিতকরণের কাজসহ বিভিন্ন সরকারি জরুরী সেবার সাশ্রয়ী ডেলিভারি নিশ্চিতকরণে এই স্পেসসমূহ ব্যবহার করা হবে।
ডিএমটিসিএল-এটুআই এর মধ্যকার চুক্তির ফলে, মেট্রোরেল ব্যবহারকারী যাত্রীগণ দেশীয় প্রসিদ্ধ ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মে তাদের ক্রয়কৃত পণ্য সমূহের ডেলিভারি তাদের নিয়মিত দৈনিক মেট্রোরেল ভ্রমণের আগে বা পরে সুবিধামত সময়ে মেট্রোরেল স্টেশনে স্থাপিত স্মার্ট লকার ডিজিবক্স থেকেই সংগ্রহ করতে পারবেন। এজন্য নিজ স্মার্টফোনে প্রাপ্ত ওটিপি (একবার ব্যবহারযোগ্য গোপন সংখ্যা) মেট্রোরেল স্টেশনে অবস্থিত স্মার্ট লকারের ডিসপ্লে স্ক্রীনে প্রবেশ করালে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্দিষ্ট লকারটি খুলে যাবে, এবং ক্রেতা তার ক্রয়কৃত পণ্য সেই লকার থেকে নিজেই সংগ্রহ করতে পারবেন। এতে কোন ডেলিভারিম্যানের উপস্থিতির প্রয়োজন হচ্ছে না।
মেট্রোরেলের যাত্রীরা এই উদ্ভাবনী প্রযুক্তির মাধ্যমে উপকৃত হবেন বলে আশা করছে এটুআই এবং ডিএমটিসিএল। সামগ্রিকভাবে, দেশে দ্রুত ক্রমবর্ধমান ই-কমার্স খাতের পণ্য ডেলিভারিতে এই স্মার্ট-লকারের সংযোজন দেশের ভোক্তাদের মূল্যবান সময়, শ্রম ও অর্থের সাশ্রয় করবে নিশ্চিতভাবেই।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম, এ, এন, ছিদ্দিক বলেন, “মেট্রোরেল ও এর ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সিসিটিভির আওতায় নিয়ে এসেছি, ফেইস ডিটেক্টর প্রযুক্তি সংযুক্ত করেছি। বর্তমানে আমরা মেট্রোরেলের দায়িত্বে থাকা পুলিশবাহিনীর জন্য তথ্যপ্রযুক্তির দক্ষতা নিশ্চিতকরণের কাজ করছি।”
এটুআই-এর প্রশংসা করে তিনি বলেন, “প্রযুক্তিনির্ভর এই ধরনের যেকোন উদ্যোগের সাথে এমআরটি পাশে থাকবে। এর সুফল দেশের মানুষ ভবিষ্যতে পাবে।”
তিনি আরও বলেন, “স্মার্ট বাংলাদেশের অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে এমআরটি। আমরা একসময় খুব অনিশ্চয়তার সাথে ভেবেছি কিভাবে দূর নিয়ন্ত্রিত উপায়ে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে মেট্রোরেল চলবে, তিন মিনিট পর পর ট্রেন আসবে। আইসিটির সহযোগিতায় এখন সেসব বাস্তব। আমরা ইতিমধ্যেই এমআরটিতে অনেক ক্ষেত্রেই ক্যাশলেস সেবা নিশ্চিত করেছি। আমরা প্রতিবন্ধীবান্ধব মেট্রোরেল অভিজ্ঞতা নিশ্চিত করেছি। দেশীয় ইনোভেশনগুলোকে ব্যবহার করে এটুআই-এর মাধ্যমে আইসিটির যে উন্নয়ন সাধিত হয়েছে, সেগুলোকে ব্যবহার করে নির্ধারিত সময়ের আগেই আমরা এমআরটি চালু করতে পেরেছি, যার উদাহরণ বিশ্বেই খুব কম। তারই ধারাবাহিকতায় এটুআই’এর এই আইওটি স্মার্ট লকার আমাদের স্মার্ট বাংলাদেশের পথে অভিযাত্রায় নতুন সংযোজন হবে।”
ডিএমটিসিএল এর কোম্পানি সচিব (যুগ্মসচিব) মোহাম্মদ আবদুর রউফ বলেন, “স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে ডিএমটিসিএল এমআরটি ৬ মেট্রোরেল সংযোজনের মাধ্যমে রাজধানীবাসীর দৈনন্দিন জীবনকে সহজ করার যে কাজ করছে, সেই অভিযাত্রায় এটুআই-এর এই সংযুক্তি প্রশংসনীয়। মেট্রোরেল ব্যবহারকারীদের স্মার্ট বাংলাদেশের সুবিধা দেবার লক্ষ্যে প্রতিটি মেট্রোরেল স্টেশনে এই ডিজিবক্স স্থাপনের মাধ্যমে মানুষের জীবনযাত্রাকে আরো স্মার্ট করার লক্ষেই আজকের এই চুক্তি স্বাক্ষরের উদ্যোগ।”
দেশের প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শিতার উদাহরণ দিয়ে এটুআই-এর প্রকল্প পরিচালক (যুগ্মসচিব) ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর বলেন, “যেসময় তিনি ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নের কথা বলেছিলেন, তখন বেশির ভাগ মানুষের কাছেই তা অবাস্তব মনে হয়েছিল। অথচ, তখন থেকে যদি আমরা প্রযুক্তিবান্ধব না হতাম, করোনা মহামারির সময়ে আমরা কোনভাবেই মহাবিপর্যয় ঠেকাতে পারতাম না। লকডাউনের সময় ই-কমার্সের মাধ্যমে, ৩৩৩ এর সেবার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে নিত্যপণ্য পৌঁছে দেয়া গেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ অর্জনের এই পর্যায়ে এসে আমরা এখন স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণে কাজ শুরু করেছি। আমরা সব সেবাকে প্রতিবন্ধীবান্ধব করতে চাই।” ডিএমটিসিএল-এর বর্তমান নেতৃত্বের আন্তরিকতার প্রশংসা করে তিনি বলেন, “মেট্রোরেলগুলোকে এক্সেসিবল করা হয়েছে। ‘সুরক্ষা অ্যাপের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, “আমরা নিজেদের প্রযুক্তিতে নিজ দক্ষ জনবলে নিজেদের মত করে নিজেদের দেশের জন্য সমাধানগুলো তৈরি করতে চাই।”
ডিজিবক্সের নিরাপত্তার জন্য সার্বিক সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত ডিএমটিসিএল, এমনটাই জানিয়েছে ডিএমটিসিএল-এর এমআরটি লাইন-৬ এর প্রকল্প পরিচালক মোঃ আফতাবউদ্দিন তালুকদার। তিনি নতুন এই উদ্যোগ নিয়ে প্রত্যাশা ব্যক্ত করে বলেন, “এমআরটি লাইন ৬-এর প্রকল্প পরিচালক হিসেবে আমরা মোট ১৭টি স্টেশন নির্মাণ করতে যাচ্ছি, প্রতিটি স্টেশনে এরকম অত্যাধুনিক প্রযুক্তির নতুন নতুন ডিজিটাইজেশনের মধ্য দিয়ে এটুআই-এর মাধ্যমে স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণের ধারাবাহিকতায় আমরা সহযোগী হিসেবে থাকব।”
মেট্রো স্টেশনে এটুআই-এর স্মার্ট লকার সেবা শুধু পণ্য লেনদেনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না। ধারাবাহিকভাবে সরকারের যাবতীয় ডিজিটাল সেবা ও লেনদেনও এর আওতাভুক্ত হবে জানান এটুআই- প্রকল্পের পলিসি অ্যাডভাইজর আনীর চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘এটুআই এর মাইগভ প্রকল্পে ১,৬০০ এরও বেশী সরকারি সেবা রয়েছে। মাইগভের সাথে ডিজিবক্স একযোগে কাজ করবে
নাগরিক জীবনযাত্রাকে আরো সহজ করার জন্য। মেট্রোরেল একটি স্টেশনের স্মার্ট লকারের কিওস্কের মাধ্যমে কেউ তার পাসপোর্টের আবেদন করে সেই পাসপোর্টের ডেলিভারিও যেন আরেক মেট্রোরেল স্টেশনের স্মার্ট লকারের মাধ্যমেই হাতে পেতে পারেন, সেটা বাস্তবায়নেও আমরা কাজ করব। আর, এই প্রক্রিয়ায় যাবতীয় সরকারী ফি এর পেমেন্ট হবে সরকারি পেমেন্ট সেবা একপে’র মাধ্যমেই।”
এটুআই-এর হেড অফ কমার্শিয়াল স্ট্রাটেজি রেজওয়ানুল হক জামী বলেন, “আজকের এই চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে মেট্রোরেল স্টেশনে স্মার্ট লকারের যাত্রা যে শুরু হচ্ছে, তা শুধু বাংলাদেশের জন্যেই প্রথম না, বরং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার যেকোন মেট্রোরেল স্টেশনের জন্যেও এটা এই ধরনের প্রথম উদ্যোগ। শুধু তাই নয়, সমগ্র এশিয়া মহাদেশে শুধু দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানে মেট্রোরেল স্টেশনে আইওটি-প্রযুক্তির স্মার্ট লকারের ব্যবস্থা রয়েছে। সেদিক বিবেচনায়, ডিএমটিসিএল এবং এমআরটি-৬ নিজেই পথিকৃৎ হিসেবে এক ইতিহাসের সৃষ্টি করল।” চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে এ ছাড়াও ডিএমটিসিএল ও এটুআই-এর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দরা উপস্থিত ছিলেন।